কঠিন, তরল ও বায়বীয় পদার্থের এই তিন অবস্থায় তাদের ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হয়ে থাকে, ফলে তাদের ব্যবহারও তিন অবস্থায় ভিন্ন হয়। এই অধ্যায়ে পদার্থের বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে তাদের ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য এবং দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করা হবে।
৪.১ কণার গতিতত্ত্ব (Kinetic Theory of Particles)
আমরা জানি যে, সকল পদার্থই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা (অণু এবং পরমাণু) দ্বারা গঠিত। এই সমস্ত কণার গতিশক্তি তাপমাত্রা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং পদার্থটি কোন অবস্থায় (কঠিন, তরল বা গ্যাসীয়) থাকবে সেটি প্রভাবিত করে। পদার্থের এই কণাগুলো একে অপরকে আকর্ষণ করে এবং সে কারণে কণাগুলোর মাঝে একধরনের আন্তঃকণা আকর্ষণ (আন্তঃআণবিক বা আন্তঃপারমাণবিক) শক্তি থাকে। কণাগুলোর গতিশক্তি এবং আন্তঃকণা আকর্ষণ শক্তি দিয়ে পদার্থের কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় অবস্থা ব্যাখ্যা করা যায় এবং ব্যাখ্যা করার এই তত্ত্বকে কণার গতিতত্ত্ব (Kinetic theory of particles) বলা হয়।
কঠিন পদার্থে কণাগুলোর মধ্যে আকর্ষণ শক্তি খুব বেশি থাকে। ফলে, কণাগুলো তাদের নিজেদের মধ্যে খুব কাছাকাছি বা ঘনিষ্ঠভাবে অবস্থান করে এবং নিজেদের অবস্থান থেকে নড়াচড়া করতে পারে না। যখন কোনো কঠিন পদার্থকে তাপ দেওয়া হয়, তখন কণাগুলো তাপশক্তি গ্রহণ করে কাঁপতে (vibrate) থাকে। যখন আরও বেশি তাপ দেওয়া হয়, তখন কণাগুলো এত বেশি কাঁপতে থাকে যে সেগুলো আন্তঃকণা আকর্ষণ শক্তি থেকে নিজেদের খানিকটা মুক্ত করে কিছুটা গতিশক্তি লাভ করে। পদার্থের এই অবস্থা হচ্ছে তরল অবস্থা। আমরা জানি যে, তরল পদার্থের নির্দিষ্ট আয়তন থাকলেও নির্দিষ্ট আকার থাকে না। এই অবস্থায় তরল পদার্থকে আরও বেশি তাপ দিলে কণাগুলো তাপশক্তি গ্রহণ করে তাদের গতিশক্তি বাড়াতে থাকে এবং এক সময় গতিশক্তি এত বেশি বেড়ে যায় যে, কণাগুলো তাদের নিজেদের মধ্যে আকর্ষণ শক্তি থেকে প্রায় মুক্ত (free) হয়ে বিক্ষিপ্তভাবে ছুটতে শুরু করে। এই অবস্থায় তরল পদার্থ গ্যাসীয় পদার্থে পরিণত হয় (চিত্র ৪.১)। আমরা জানি যে, গ্যাসীয় অবস্থায় পদার্থের নির্দিষ্ট কোনো আয়তন থাকে না, তাদেরকে যে পাত্রে রাখা হবে কণাগুলো সেই আয়তনের পাত্রে ছোটাছুটি করতে থাকে। গ্যাসীয় অবস্থা প্রাপ্ত হওয়ার পর আরও তাপ প্রয়োগ করে হলে কণাগুলো তখন আরও বেশি জোরে ছুটতে থাকবে এবং কণাগুলোর গতিশক্তি বৃদ্ধি পাবে।
চিত্র ৪ ১: কঠিন, তরল ও গ্যাসীয়
৪.২ ব্যাপন (Diffusion)
কোনো পদার্থ যদি উচ্চ ঘনমাত্রায় থাকে, তখন সে পদার্থের কণাগুলো নিম্ন ঘনমাত্রার দিকে ধাবিত হতে চায়। কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় পদার্থের উচ্চ ঘনমাত্রার স্থান থেকে নিম্ন ঘনমাত্রার স্থানে স্বতঃস্ফূর্ত ও সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ার এই প্রক্রিয়াকে ব্যাপন বলে (চিত্র ৪.২)। ব্যাপন প্রক্রিয়ার জন্য পদার্থের ঘনমাত্রার পার্থক্য থাকতে হয়। ব্যাপন প্রক্রিয়ার উদাহরণ হিসেবে আমরা পারফিউমের খোলা বোতলের কথা বলতে পারি। ঘরের এক কোনে একটি পারফিউমের খোলা বোতল রাখলে তার সুগন্ধ কিছুক্ষণের মাঝে ঐ ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়াটি ব্যাপনের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়তে যদি কম সময় লাগে তখন আমরা বলি তার ব্যাপন হার বেশি। আবার যদি ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগে তখন তার ব্যাপন হার কম। ব্যাপনের হার কণার আকার এবং ভরের উপরও নির্ভর করে। বড়ো আকারের কণার তুলনায় ছোটো কণা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে ছোটো কণার ব্যাপনের হার বড়ো কণার থেকে বেশি।
চিত্র ৪.২: গ্যাসের ব্যাপন প্রক্রিয়া
কঠিন পদার্থের ব্যাপন প্রক্রিয়া:
তুমি যদি একটি কাপে গরম পানি নিয়ে তাতে টিব্যাগ ডুবাও, তাহলে দেখতে পাবে টিব্যাগ থেকে নির্গত কালচে লাল রঙের চায়ের নির্যাস বা লিকার বের হয়ে ধীরে ধীরে কাপের পানির মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে। (চিত্র ৪.৩) কিছুক্ষণ পর তুমি যখন টিব্যাগটি কাপ থেকে তুলে আনবে, তখন দেখতে পাবে যে, কাপের পুরো পানির রং কালচে- লালের মতো হয়েছে, অর্থাৎ টিব্যাগে থাকা চায়ের পাতার রং ব্যাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাপের পুরো পানির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কাপে গরম পানি ব্যবহার করার কারণে ব্যাপনের হার বেশি, তুমি যদি কাপে ঠান্ডা পানি নিয়ে তাতে টিব্যাগ ডুবিয়ে রাখ, তাহলে দেখবে লিকার অনেক আস্তে আস্তে ছড়াচ্ছে। গরম পানির ক্ষেত্রে চায়ের নির্যাসের কণাগুলো পানি থেকে তাপ গ্রহণ করে অধিক গতিশক্তি লাভ করে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, কম তাপমাত্রায় যেটি অনেক ধীর গতিতে ঘটে।
চিত্র ৪.৩: পানিতে চায়ের নির্যাসের ব্যাপন
তরল পদার্থের ব্যাপন প্রক্রিয়া:
তোমরা একটি গ্লাস, কিংবা স্বচ্ছ কোনো পাত্রে কিছু পরিমাণ পানি নিয়ে যদি ড্রপার দিয়ে এক দুই ফোঁটা নীল রঙের ফুড কালার দাও তাহলে দেখবে নীল রংটি গ্লাসের পানিতে ছড়িয়ে পড়ছে (চিত্র ৪.৪)। ধীরে ধীরে সমস্ত পানির রং নীল রঙে পরিণত হবে, অর্থাৎ নীল ফুড কালারের কণাগুলো ব্যাপনের মাধ্যমে বিকারের সমস্ত পানিতে ছড়িয়ে পড়বে। শীতল পানিতে প্রক্রিয়াটি হবে ধীরে ধীরে কিন্তু গরম পানি নিলে সেটি ঘটবে খুব দ্রুত।
চিত্র ৪.৪: পানিতে নীল রঙের দ্রবণের ব্যাপন
দুটি গ্যাসীয় পদার্থের ব্যাপন:
তোমাদের বলা হয়েছে যে গ্যাসের কণা যদি ছোটো হয় তাহলে ব্যাপনের হার বেশি হয়। প্রকৃত ল্যাবরেটরির নিরাপদ পরিবেশে একটি পরীক্ষায় এটি দেখানো হয়ে থাকে (চিত্র ৪.৫)। এই পরীক্ষাটির জন্য দুই মুখ খোলা একটি লম্বা কাচনল নেয়া হয়। তারপর ছবিতে দেখানো উপায়ে এক খণ্ড তুলাকে ঘন হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (HCI) দ্রবণে ভিজিয়ে লম্বা কাচনলের এক মুখে লাগানো অপর এক খণ্ড তুলা অ্যামোনিয়াম হাইড্রোক্সাইড NH₂OH) দ্রবণে 4 ভিজিয়ে কাচনলটির অন্য মুখে লাগানো হয়। তখন HCl দ্রবণে ভেজানো তুলা থেকে HCl গ্যাস ও NHон 4 দ্রবণে ভেজানো তুলা থেকে NH, গ্যাস বের হবে এবং কাচনলের ভেতরে তাদের ব্যাপন শুরু হবে।
কিছুক্ষণ পর HCI গ্যাস ও NH, গ্যাস পরস্পরের সঙ্গে বিক্রিয়া করে অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড (NH,CI) উৎপন্ন করতে শুরু করবে যেটি কাচনলের ভেতর সাদা ধোঁয়া হিসেবে দেখা যাবে। তবে দেখা যাবে যে, সাদা ধোঁয়া কাচনলের ঠিক মাঝামাঝি স্থানে নেই, এটি NH₂OH দ্রবণে ভেজানো তুলা থেকে দূরে এবং HCl দ্রবণে ভেজানো তুলার কাছাকাছি অবস্থান করছে। এ থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে যে NH, গ্যাস HCI গ্যাসের তুলনায় দ্রুত ছড়িয়ে বেশি দূরত্ব অতক্রম করেছে। NH, গ্যাসের আণবিক ভর 17 এবং HCI গ্যাসের আণবিক ভর 36.5 তাই NH, গ্যাসের ব্যাপন হার HCl গ্যাসের ব্যাপন হার থেকে বেশি এবং এই গ্যাস বেশি দূরত্ব অতিক্রম করেছে।
৪.৩ নিঃসরণ (Effusion)
নিঃসরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে কোনো পাত্রে থাকা গ্যাস সরু ছিদ্রপথ দিয়ে পাত্রের ভিতরের উচ্চচাপের স্থান থেকে পাত্রের বাইরে নিম্নচাপের স্থানের দিকে সজোরে বেরিয়ে আসে (চিত্র ৪.৬)। এই ধরনের সরু ছিদ্রকে অনেক সময় পিনহোল (pinhole) বলা হয়। এভাবে পাত্র থেকে গ্যাস বেরিয়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে পাত্রের ভিতরের এবং বাইরের চাপের পার্থক্য। ব্যাপনের বেলাতে এটি ঘটে গ্যাসের ঘনত্বের পার্থক্যের কারণে কিন্তু নিঃসরণের বেলায় এটি ঘটে গ্যাসের চাপের কারণে। অর্থাৎ ব্যাপনের ক্ষেত্রে চাপের কোনো প্রভাব নেই কিন্তু নিঃসরণের বেলায় চাপের প্রভাব আছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো, ব্যাপনের ক্ষেত্রে কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় পদার্থ উপযুক্ত মাধ্যমে সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু নিঃসরণের ক্ষেত্রে শুধু গ্যাসীয় পদার্থ গ্যাসীয় মাধ্যমে সরু ছিদ্রপথ দিয়ে বেশ বেগে বের হয়ে আসে।
এবার নিঃসরণের কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। ফুলানো বেলুনে একটি সূক্ষ্ম ফুটো করতে পারলে বেলুনের ভেতরের উচ্চ চাপে থাকা বাতাস সেই ছিদ্রপথে নিঃসরণের মাধ্যমে সবেগে বের হয়ে আসবে। ফুলানো বেলুনে ফুটো করার চেষ্টা করলে টানটান হয়ে থাকা বেলুনটি ফুটোর চারপাশে খুব দ্রুত সরে
গিয়ে ফুটোটিকে বড়ো করে ফেলতে চায় বলে বেলুনটি ফেটে যায়। যেখানে ফুটো করা হবে সেখানে এক টুকরো স্কচ টেপ লাগিয়ে তার উপর আলপিন দিয়ে ফুটো করা হলে বেলুনটি আর ফেটে যাবে না। তখন বেলুন থেকে বাতাস ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকবে এবং ধীরে ধীরে বেলুনটি চুপসে যাবে। বেলুনের ভেতর বাতাসের চাপ, বেলুনের বাইরের বাতাসের চাপ থেকে বেশি বলে উচ্চচাপের কারণে ফুটো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেলুনের বাতাস অপেক্ষাকৃত নিম্নচাপের দিকে ধাবিত হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়াটিই হচ্ছে নিঃসরণ।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা নিঃসরণের আরও উদাহরণ দেখতে পাই। যেমন- আমরা বিভিন্ন যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে সিএনজি (CNG: Compressed Natural Gas) ব্যবহার করে থাকি। সিএনজি হচ্ছে মূলত উচ্চচাপে সংকুচিত মিথেন (CH) গ্যাস। এক্ষেত্রে যানবাহন চালানোর সময় সিএনজি সিলিন্ডার থেকে মিথেন গ্যাস নিঃসরিত হয়ে গাড়ি বা যানবাহনের ইঞ্জিনে প্রবেশ করে। আবার আমরা আমাদের বাসাতেও অনেক সময় রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে সিলিন্ডারে রক্ষিত গ্যাস ব্যবহার করি। এক্ষেত্রে, আসলে প্রোপেন (C,H.) ও বিউটেন (CH₁) গ্যাসকে উচ্চচাপে সংকুচিত করে তরল অবস্থায় সিলিন্ডারে ভর্তি করে রাখা হয়। গ্যাসের চুলা জ্বালানোর সময় সিলিন্ডারের মুখ খুলে দেওয়া হলে এটি গ্যাসে পরিণত হয়ে সবেগে বের হয়ে আসে। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও নিঃসরণ ঘটে থাকে।
৪.৪ পাতন এবং ঊর্ধ্বপাতন (Distillation and Sublimation)
৪.৪.১ পাতন (Distillation):
তোমরা জানো যে, তরল পদার্থকে তাপ প্রয়োগ করে বাষ্পে পরিণত করার প্রক্রিয়াকে বাষ্পীভবন বলে। তোমরা সবাই নিশ্চয়ই কেতলিতে পানি গরম করার সময় পানিকে বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যেতে দেখেছ। আবার, বাষ্পকে শীতল করলে তা তরলে পরিণত হয়, যাকে আমরা ঘনীভবন বলি। শীতল করে রাখা কোমল পানীয়ের বোতলের গায়ে আমরা ছোটো ছোটো জলকণা দেখি, এখানে জলীয় বাষ্প তার তাপশক্তি নির্গত করে ঠান্ডা হয়ে পানির কণায় পরিণত হয়। এটি ঘনীভবনের উদাহরণ।
অন্যদিকে পাতন হচ্ছে কোনো তরলকে তাপ দিয়ে বাষ্পে পরিণত করে তাকে পুনরায় শীতলীকরণের মাধ্যমে তরলে পরিণত করার প্রক্রিয়া (চিত্র ৪.৭)। সুতরাং, পাতনকে নিম্নোক্তভাবে বলা যায়:
পাতন = বাষ্পীভবন ঘনীভবন (Distillation = Vaporization + Condensation)
উল্লেখ্য যে, পাতন প্রক্রিয়ায় কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া হয় না। কোনো মিশ্রণে একাধিক উপাদান থাকলে সে মিশ্রণ থেকে উপাদানসমূহকে বিশুদ্ধভাবে পেতে পাতন প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়। সুতরাং, এটি হচ্ছে মিশ্রণ থেকে কোনো উপাদানকে পৃথকীকরণ পদ্ধতি।
চিত্র ৪.৭: ল্যাবরেটরিতে পাতনের পরীক্ষা
ল্যাবরেটরির নিরাপদ পরিবেশে যথাযথ পাত্র ব্যবহার করে পাতনের পরীক্ষা করা যায়। যেমন- পানিতে অপদ্রব্য মেশানো থাকলে পাতনের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানিকে আলাদা করে নেওয়া যায়। রাসায়নিক শিল্প কলকারখানাতেও ব্যাপকভাবে পাতন ব্যবহার করা হয়। যেমন- তেলের খনি থেকে যে অপরিশোধিত তেল (Crude oil) উত্তোলন করা হয় সেগুলো পাতনের মাধ্যমে পরিশোধন করা হয় (চিত্র ৪.৮)। শুধু তাই নয় ভিন্ন ভিন্ন তাপমাত্রায় অপরিশোধিত তেল থেকে ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্যকে আলাদা করা হয়। এই পদ্ধতিকে আংশিক পাতন (fractional distillation) বলা হয়।
৪.৪.২ ঊর্ধ্বপাতন (Sublimation):
ঊর্ধ্বপাতন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে কোনো কঠিন পদার্থকে তাপ প্রয়োগ করলে সেটি তরলে পরিণত না হয়ে সরাসরি বাষ্পে পরিণত হয়। তোমরা হয়তো সবাই ন্যাপথালিনের নাম শুনেছ বা দেখেছ। কাপড়কে পোকা থেকে রক্ষা করতে ন্যাপথালিন ব্যবহার করা হয়। এই ন্যাপথালিনকে তাপ দিলে সেটি প্রথমে তরল না হয়ে সরাসরি গ্যাসীয় পদার্থে পরিণত হয়। ড্রাই আইস (Dry ice) হচ্ছে হিমায়িত কার্বন ডাইঅক্সাইডের একটি কঠিন রূপ। ড্রাই আইস বায়বীয় বা গ্যাসীয় অবস্থায় তার কঠিন অবস্থা থেকে অধিক স্থিতিশীল। এটি যখন বাতাসের সংস্পর্শে আসে তখন সেটি কঠিন অবস্থা থেকে সরাসরি গ্যাসীয় অবস্থায় পরিবর্তিত হয়। এটিও ঊর্ধ্বপাতনের আরেকটি উদাহরণ।
এছাড়া, নিশাদল (NHCl), কপূর (C₁₂H₂O), আয়োডিন (1₂), অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড (AICI), এই পদার্থগুলোকে তাপ দিলে সেগুলো তরলে পরিণত না হয়ে সরাসরি বাষ্পে পরিণত হয়। এই পদার্থগুলোকে ঊর্ধ্বপাতিত পদার্থ বলা হয়। ল্যাবরেটরির যথাযথ নিরাপদ পরিবেশে নিচের এই সহজ পরীক্ষাটি দিয়ে খুব সহজে ঊর্ধ্বপাতন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা যায় (চিত্র ৪.৯)। একটি বিকারে কিছু পরিমাণ অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড (NHCI) নিয়ে বিকারের খোলা মুখটি একটি কাচের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। তারপর কাচের ঢাকনার উপর কিছু বরফখণ্ড রাখা হয় যেন বাষ্পীকৃত অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড ঠান্ডা হয়ে ঢাকনার নিচে জমা হতে পারে। এবার বিকারে তাপ প্রয়োগ করলে দেখা যাবে কঠিন অবস্থার অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড গ্যাসীয় অবস্থায় পরিণত হচ্ছে। এই বাষ্পীকৃত বা গ্যাসীয় অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড উপরে উঠে কাচের ঢাকনায় গিয়ে শীতল হয়ে পুনরায় কঠিন অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড হিসেবে ঢাকনার নিচে জমা হতে থাকবে।
কোনো কঠিন পদার্থের মিশ্রণের মধ্যে যদি একটি ঊর্ধ্বপাতিত পদার্থ মিশ্রিত থাকে, তাহলে ঐ ঊর্ধ্বপাতিত পদার্থকে মিশ্রণ থেকে সহজেই পৃথক করা যায়। যেমন- খাবার লবণের (NaCl) সঙ্গে অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড (NH,Cl) বা নিশাদল মিশ্রিত থাকলে ঊর্ধ্বপাতন প্রক্রিয়ায় নিশাদলকে আলাদা করা যাবে।
আবার, আয়োডিন মিশ্রিত খাবার লবণ থেকে ঊর্ধ্বপাতন পদ্ধতিতে আয়োডিনকে আলাদা করা যায়। আমরা ইতিমধ্যে জানি যে, কঠিন অবস্থায় ঊর্ধ্বপাতিত পদার্থে তাপ প্রয়োগ করতে থাকলে তা সহজেই বাষ্পীভূত বা গ্যাসীয় অবস্থায় পরিণত হয়। কাজেই আয়োডিন মিশ্রিত খাবার লবণে তাপ প্রয়োগ করলে আয়োডিন সহজেই বাষ্পীভূত হয়ে যাবে। আবার ঐ বাষ্পকে ঠান্ডা করলে তা কঠিন আয়োডিনে পরিণত হবে।
আরও দেখুন...